ফ্রিল্যান্স: দিনে এক কোটি টাকা আয় করেছেন তারা
মুক্ত পেশা বা ফ্রিল্যান্স কাজ করার প্রতি তরুণরা ঝুঁকছেন। কারিগরি ও ভাষাজ্ঞান কাজে লাগিয়ে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনছেন শিক্ষিত তরুণরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী এবং অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরাই এ অনলাইন আউটসোর্সিং কাজে যুক্ত হচ্ছেন। ঘরে বসে পছন্দের কাজ করার মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের সুবিধার কারণেই এ পেশা তারা গ্রহণ করছেন।
ফ্রিল্যান্স: ‘দিনে এক কোটি টাকা আয় করেছেন তারা’,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
সাম্প্রতিক সময়ে দিনে এক কোটি টাকা আয় করছেন তারা। চলতি বছরে এ আয়ের পরিমাণ দৈনিক দুই কোটি টাকা স্পর্শ করবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, গত বছর এ খাত থেকে ৪ কোটি ৬০ লাখ ডলার আয় করেছেন ফ্রিল্যান্সাররা। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তারা সুনাম কুড়াচ্ছেন। মুক্তপেশা সম্পর্কে ব্যাপক প্রচার, ইন্টারনেট ব্যবহারের কম মূল্য এবং প্রযুক্তিগত ও ভাষাগতভাবে দক্ষরা এ পেশা গ্রহণ করলে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে তথ্যপ্রযুক্তিগত বিপ্লব সম্ভব বলে মনে করেন প্রযুক্তি বিশ্লেষকরা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশি ফ্রিল্যান্সাররা বিশ্ববাজারে শীর্ষ তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ স্থানে অবস্থান করছেন।
তবে ফ্রিল্যান্সারদের অনেকেই কিছুদিন কাজ করে আর অনলাইন আউটসোর্সিংয়ে যুক্ত থাকেন না। ২০১২ সালে দেশে প্রায় ১৪ হাজার ফ্রিল্যান্সার এ পেশায় নিয়মিত যুক্ত ছিলেন। চলতি বছরে তা আরো বেড়েছে। তবে মুক্তপেশাজীবীদের অধিকাংশই রাজধানী ঢাকায় অবস্থান করছেন। একটা সময় তারা নির্দিষ্ট কিছু কাজের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকলেও এখন আর তেমনটি নেই। আউটসোর্সিং কাজের বিভিন্ন খাতে পদচারণা বাড়ছে বাংলাদেশি ফ্রিল্যন্সারদের এবং সফলতাও আসছে।আউটসোর্সিং কাজ পাওয়ার জন্য জনপ্রিয় ওয়েবসাইট বা গ্লোবাল মার্কেট প্লেস হলো ওডেস্ক (www.odesk.com). এছাড়া দেশীয় ফ্রিল্যান্সারদের দুটি সাধারণ ফোরাম হলো ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক এবং ফ্রিল্যান্সফেস্ট (FreelanceFest.com). এ দুই প্রতিষ্ঠান সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ৫০ হাজার তরুণ ফ্রিল্যান্সার হিসেবে অনলাইন আউটসোর্সিং করছেন। এর মধ্যে অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার পাঠ চুকিয়েও অনেকে এ পেশা গ্রহণ করছেন।
ইন্টারনেটভিত্তিক আউটসোর্সিং করে অর্থ উপার্জন করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র মো. আল আমিন। তিনি বলেন, ঘরে বসে ঝুঁকিহীন কাজ হলো ফ্রিল্যান্সিং। সকলের সব বিষয়ে জানাশোনা নেই। ফ্রিল্যান্সিংয়ে ইচ্ছুক যে কেউ তার পছন্দের বিষয়ে কাজ শুরু করতে পারেন। তবে নির্দিষ্ট বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ধারণা এবং ইংরেজি ভাষাজ্ঞান ভালো হতে হবে। নইলে অনেক কাজই সঠিক সময়ে কিংবা ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করা যায় না। তিনি জানান, একজন তরুণ ফ্রিল্যান্সিং করে মাসে ঠিক কত টাকা আয় করতে পারেন, তা নির্ভর করে ঐ ব্যক্তির দক্ষতার উপর। সাধারণত প্রতি মাসে কাজের ধরনভেদে ৩০ হাজার থেকে চার-পাঁচ লাখ টাকা আয় করা সম্ভব।
ওপেনসোর্স নেটওয়ার্কের সাধারণ সম্পাদক মুনীর হাসান বলেন, আমাদের তরুণরা উদ্যমী। কাজ করতে আগ্রহী। এরই কিছু অংশ ফ্রিল্যান্স কাজ শুরু করেছেন। তবে কারিগরি দুর্বলতা এবং ভাষাগত অদক্ষতার কারণে অনেকেই এ ধরনের কাজ নিয়মিতভাবে করতে পারেন না। তবে স্বল্প সংখ্যক ফ্রিল্যান্সার যে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আনছেন, তা ঈর্ষণীয়। সরকার এ খাতে সহায়তা দিলে আইটি খাতে বিপ্লব অবসম্ভাবী।
তিনি বলেন, আউটসোর্সিং এখনো অনেকটাই ঢাকা কেন্দ্রিক। ঢাকার বাইরে ব্রডব্যান্ড সংযোগ কম এবং ইন্টারনেটের ধীরগতি থাকার কারণে এটি হচ্ছে। আবার দক্ষ লোকেরও অভাব রয়েছে। তবে বিভিন্ন কর্মশালা আয়োজনের মাধ্যমে এ অদক্ষতা অনেকাংশে দূর করা সম্ভব।
দেশে ইন্টারনেটের মূল্য আগের চেয়ে অনেক কমেছে। উচ্চশিক্ষিত এবং শহুরে তরুণদের একটি বড় সংখ্যক ল্যাপটপ বা কম্পিউটার ব্যবহার করছেন। আগ্রহ এবং আউটসোর্সিংয়ের সাথে পরিচয়ের মাধ্যমেই তারা যুক্ত হন পেশায়। পরবর্তীতে কেউ পার্টটাইম এবং ফুলটাইম হিসেবেই এ পেশায় যুক্ত থাকেন।
তরুণদের সাক্ষাত্কার গ্রহণ ও বিশ্লেষণে দেখা যায়, ফ্রিল্যান্সিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয় তরুণদের এগিয়ে আসার বড় কারণ ফ্রি ইন্টারনেট অথবা অপেক্ষাকৃত ইন্টারনেট সেবাপ্রাপ্তি। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, একাডেমিক ভবন এবং বিভিন্ন হলে ওয়াইফাই ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। এছাড়া অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহারেরও সুযোগ রয়েছে। রাজধানী কিংবা এর আশপাশে অবস্থিত অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও এ সুযোগ কম-বেশি রয়েছে।
বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোটাই ওয়াইফাই নেটওয়ার্কভুক্ত। ইন্টারনেট সংযোগের সহজপ্রাপ্যতা এবং সুলভমূল্যের কারণেই তরুণরা এ পেশায় সহজে প্রবেশ করছেন। তবে কারিগরি অদক্ষতা ও ভাষাগত দুর্বলতার কারণে অনেকেই এ পেশায় বেশি দিন টিকে থাকেন না। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে আউটসোর্সিংয়ে সবচে বেশি জড়িত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বুয়েটের ছাত্ররা। তবে বুয়েটে ইন্টারনেট সহজলভ্য নয় বলে দাবি করেছেন শিক্ষার্থীরা। ইন্টারনেট সংযোগ সহজলভ্য হলে তারা প্রযুক্তিগত অনেক কাজ সহজেই করতে পারতেন বলেন জানান।
আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং এআইইউবির শিক্ষার্থীরা এ পেশায় জড়িত। বেসরকারিভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও এখন আউটসোর্সিংকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্টিং বিভাগের ছাত্র ফয়সাল আহমেদ তুষার জনান, তার হলে ইন্টারনেট সংযোগ দুর্বল। তাই অনুষদের ফ্রি ইন্টারনেট তিনি ব্যবহার করে সংশ্লিষ্ট ক্রেতাদের (বায়ার) সাথে যোগাযোগ ও চুক্তি করেন। অনুষদে বসেই ইন্টারনেট থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করেন। এরপর হলে গিয়ে কাজ সম্পন্ন করেন।
নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সজিব কুমারও প্রায় একই পদ্ধতি অনুসরণ করেন বলে জানিয়ে বলেন, মোবাইল অপারেটরদের ইন্টারনেট সেবার গতি অপেক্ষাকৃত ধীর বলে তিনি ক্যাম্পাসকেই এ কাজের জন্য বেছে নিয়েছেন।
দেশে আউটসোর্সিং কাজ বিনিময়-চুক্তির জনপ্রিয় জায়গা হলো ওডেস্ক। অনলাইনে বিভিন্ন মার্কেট প্লেসের মধ্যে ওডেস্কের অবস্থান শীর্ষে। এ সাইট থেকে জানা যায়, তরুণরা ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, নেটওয়ার্কিং ও ইনফরমেশন সিস্টেমস, লেখালেখি ও অনুবাদ, প্রশাসনিক সহযোগিতা, ডিজাইন ও মাল্টিমিডিয়া, গ্রাহকসেবা, বিক্রয় ও বিপণন এবং ব্যবসায় সেবা বিষয়ে বেশি কাজ করেন। এ কাজগুলোতে তারা সুনামও কুড়াচ্ছেন। ২০১২ সালে ফ্রিল্যান্সারদের তালিকায় গ্লোবালাইজেশন বিভাগের তিনটিতে শীর্ষে আছেন বাংলাদেশি ফ্রিল্যান্সার সাঈদ ইসলাম। এর মধ্যে নেটওয়ার্ক অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের লিনাক্স এবং অ্যাসটারিস্ক ও সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট বিভাগের ভিওআইপিতে শীর্ষ অবস্থান তিনি দখল করেন। তিনি বর্তমানে ওডেস্কের হয়েও কাজ করছেন।
আউটসোর্সিং ও ফ্রিল্যান্স
ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ধরনের কাজ করিয়ে নেয়। নিজ প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্য কাউকে দিয়ে এসব কাজ করানোকে আউটসোর্সিং বলে। যারা আউটসোর্সিংয়ের কাজ করে দেন, তাদের ফ্রিল্যান্সার বলে। ফ্রিল্যান্সার অর্থাত্ মুক্ত বা স্বাধীন পেশাজীবী। আউটসোর্সিংয়ের কাজের খোঁজ থাকে, এমন সাইটে যিনি কাজটা করে দেন, তাকে বলা হয় কন্ট্রাকটর, তিনি চুক্তিতে কাজ করেন। আর যিনি কাজ দেন, তাকে বলে বায়ার/এমপ্লয়ার। তিনি চুক্তিতে কাজ দেন।
আউটসোর্সিং কাজ প্রাপ্তির স্থান
আউটসোর্সিং সাইট বা অনলাইন মার্কেট প্লেসে কাজ বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা থাকে। এর মধ্যে ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, নেটওয়ার্কিং ও ইনফরমেশন সিস্টেম, লেখা ও অনুবাদ, প্রশাসনিক সহায়তা, ডিজাইন ও মাল্টিমিডিয়া, গ্রাহকসেবা, বিক্রয় ও বিপণন, ব্যবসা সেবা রয়েছে।
ওয়েব ডেভেলপমেন্টে রয়েছে—ওয়েবসাইট ডিজাইন, ওয়েব প্রোগ্রামিং, ই-কমার্স, ইউজার ইন্টারফেস ডিজাইন, ওয়েবসাইট টেস্টিং, ওয়েবসাইট প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি।
সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের মধ্যে আছে—ডেস্কটপ এপ্লিকেশন, গেম ডেভেলপমেন্ট, স্ক্রিপ্ট ও ইউটিলিটি, সফটওয়্যার প্লাগ-ইনস, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন, ইন্টারফেস ডিজাইন, সফটওয়্যার প্রকল্প-ব্যবস্থাপনা, সফটওয়্যার টেস্টিং, ভিওআইপি ইত্যাদি।
নেটওয়ার্কিং ও ইনফরমেশন সিস্টেমের মধ্যে রয়েছে—নেটওয়ার্ক এডমিনিস্ট্রেশন, ডিবিএ-ডাটাবেজ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, সার্ভার অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, ইআরপি/সিআরএম ইমপ্লিমেনটেশন ইত্যাদি। লেখালেখি ও অনুবাদ কাজের মধ্যে রয়েছে—কারিগরি নিবন্ধ লেখা, টেকনিক্যাল রাইটিং, ওয়েবসাইট কনটেন্ট, ব্লগ ও আর্টিকেল রাইটিং, কপি রাইটিং, অনুবাদ, ক্রিয়েটিভ রাইটিং ইত্যাদি।
ডিজাইন ও মাল্টিমিডিয়ার মধ্যে আছে—গ্রাফিক ডিজাইন, লোগো ডিজাইন, ইলাস্ট্রেশন, প্রিন্ট ডিজাইন, থ্রিডি মডেলিং, ক্যাড, অডিও ও ভিডিও প্রোডাকশন, ভয়েস ট্যালেন্ট, অ্যানিমেশন, প্রেজেন্টেশন, প্রকৌশল ও টেকনিক্যাল ডিজাইন ইত্যাদি।
0 Comments